নদীর নাম আত্রেয়ী

Source: Google

অনেকে আত্রাইও বলে। বালুরঘাট আসার আগে অবশ্য এই নদীর অস্তিত্ব আমার কাছে অজানা ছিলো। এখানে যেদিন এলাম, সেদিন বিকেলেই প্রথম আবিষ্কার করলাম আত্রাইকে। 

বেশ শান্ত নিরিবিলি নদী। তেমন কোনো ভিড় ভাট্টা নেই, পাহাড়ের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগাযোগ না থাকায় স্রোতে তেমন টান নেই। শুনেছি এককালে তিস্তার জল এই নদী পেরিয়ে গঙ্গায় মিশতো, তখন এর ধার ছিলো। এখন তিস্তার গতিপথ বদলে গেছে ব্রহ্মপুত্রে। একপ্রকার বিমাতার অনাদরেই ঘরের এক কোণে চুপচাপ পড়ে আছে আত্রাই।


এসেছি সঞ্জয়ের শ্বশুরবাড়ি। আমের লোভ দেখিয়ে আমাকে আর অমিতকে টেনে এনেছে সঞ্জয়। বৌদি অবশ্য আমাকে আড়ালে বলেছে, ওসব আমের লোভ টোভ কিছু নয়, বৌদির কোন এক দূরসম্পর্কের বোনকে নাকি সঞ্জয়ের খুব মনে ধরেছে অমিতের জন্য। সেই বোন আর অমিতের মধ্যে ভাব ভালোবাসা করানোর উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা এসেছি। 


ব্যাপারটা মন্দ নয়, আমি বললাম। অমিতের একটা বিয়ে শাদি দরকার।


হুম। বৌদি গম্ভীর ঘাড় নাড়লো, শুধু অমিত নয়। তোমারও দরকার। 


আমি ফিক করে হেসে বললাম, দোহাই বৌদি। তুমি যদি বলো তো আমি এক্ষুণি দু কিলোমিটার দৌড়ে আসছি, নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পড়ছি, গঙ্গায় একশো একটা ডুব দিতেও আমার অসুবিধা নেই। কিন্তু ওই বিয়ে বস্তুটি আমার দ্বারা হবে না। 


গঙ্গা থেকেই ঘুরে ফিরে এলো আত্রাইয়ের নাম। বিকেলে বৌদির সেই বোন আসবে। আমি দেখলাম, এই সুযোগ। এরা গল্প গুজবে মেতে যাবে, আমিও সেই ফাঁকে গিয়ে নদীটিকে দেখে আসবো। 


চারটের দিকে বৌদির বোন এলো। আমি চারটে পনেরোয় সিগারেটের বাহানা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। 


শহরতলি ছাড়িয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়ালাম। 

আগেই বলেছি বেশ ছিমছাম নদী। কয়েকটি দেশি নৌকো ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে। গোটা সাত আট ঘোড়েল ছেলে সমতল পাড়ে ফুটবল শটাচ্ছে। আর যেই না ফুটবল গিয়ে নদীতে পড়ছে অমনি সবগুলো ঝাঁপ মারছে জলে।


সিগারেট ধরালাম। এখান থেকে কিছুদূর গেলেই বাংলাদেশ সীমান্ত। হিলি বর্ডার। এপার বাংলার বর্ডার ঘেঁষা যত জেলা আছে সবখানেই বাঙ্গালদের আধিপত্য। কেউ হয়তো সাৎচল্লিশের সময়ে এসেছে, কেউ তার পর, কেউ একাত্তরে, কেউ তারও পর। এই বৌদিদেরই যেমন, বৌদির ঠাকুরদার বাড়ি ছিল বগুড়া― বর্ডারের ঠিক ওপাশে। এখান থেকে ঘন্টাখানেকের রাস্তা। বৌদি মাঝেমধ্যে করুণ হেসে বলে বর্ডারে গিয়ে দূরবীন লাগালে নাকি ওর দাদুর জমি দেখা যায়। অথচ সেই যে ছয়ের দশকে ওরা এসেছে আর কেউ কোনোদিন ওপাশে যায়নি। বৌদির বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার ইচ্ছে করে না যেতে?

নাহ।

কেনো? ওটা তো আপনার দেশ। বাড়ি।


উনি হেসে বলেছিলেন, ওই জন্যই ইচ্ছে করে না। নিজের বাড়িতে অতিথি হয়ে যাওয়ার চেয়ে না যাওয়াই ভালো।


অস্বীকার করবো না, উদ্বাস্তু-যন্ত্রণা বাদে পৃথিবীর যেকোনো যন্ত্রণার গাঢ়ত্ব একটু হলেও আমি বুঝতে পারি। আমার অনেক বন্ধুই বাঙ্গাল, উদ্বাস্তু। খেয়াল করে দেখেছি বাংলাদেশের কথা উঠলেই ওরা কেমন উশখুশ করে। চঞ্চল হয়ে ওঠে চোখের মণি।


হ্যাঁ। ঐদিকে গেলেই বাংলাদেশ। তারপর―


আমি ঘাড় ঘুরালাম। এক প্রায় বৃদ্ধ লোক কখন যেন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বয়সের ভারে মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে, জামা পরা থাকলেও বোঝা যায় শরীরে সার অবশিষ্ট নেই, চামড়া শুকিয়ে পাতা হয়ে গেছে। চোখদুটো ডুবুডুবু। 


আমায় কিছু বলছেন দাদু?


বৃদ্ধর যেন সম্বিৎ ফিরলো। 

হুঁ। তোমাকে। হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। সবাইকে বলি, কিন্তু কেউ শোনে না।


কী শোনে না।


ওই যে বললাম, বৃদ্ধ আঙ্গুল উঁচু করলো, ওদিকে বর্ডার, তারপর বাংলাদেশ, তারপর অনেক অনেক দূর, আত্রাই যেখানে মিশেছে, তারপর… বৃদ্ধ খেই হারালেন। আরো খানিকটা ঝুঁকে পড়লেন মাটির দিকে।


তারপর, দাদু?


তারপর? আবার জাগলেন বৃদ্ধ, মা ডাকছিল আমাকে। পাঠশালা থেকে ফিরলাম। বাবা চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। সবাই কাঁদছে। উঠোনে একটা গরুর গাড়ি। মা হাত বাড়ালো, এদিকে আয় খোকা। আমার মাকে তুমি চেনো?


না দাদু।


কতোদিন মাকে দেখি না।  একটা বিড়ি দাও না।


বিড়ি নেই দাদু। সিগারেট খাবে। 


দাও। খাই।


দুজনে দুটো সিগারেট জ্বালালাম। 

মা রোজ তুলসীতলায় প্রদীপ দেয়।  একটা বটগাছ আছে, পাঠশালার পাশে। আমরা বলি যসাই ঠাকুর। শনি মঙ্গলবারে পুজো হয়। আজ কী বার দাদুভাই?


আজ শনিবার। আমি বললাম।


বুড়ো একটু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আজ শনিবার! বাবা বাজার থেকে ফিরবে একটু পরে। আমি কাঁচাগোল্লা আনতে বলেছি। চলো চলো, ফিরি। সন্ধ্যায় পুজো দিতে হবে বটতলায়। 


বুঝলাম বুড়োর অতীত বর্তমান গুলিয়ে গেছে। স্মৃতিতেই সে ফিরে গেছে কয়েক দশক আগের তার জন্মগ্রামে। 

বটতলাটা কোথায় দাদু?


কেনো ওই যে পুলকদের বাড়ি। ওটা ছাড়িয়ে খুড়োর চায়ের দোকান, তারপরেই বটতলা। বটতলা চেনো না তুমি, তুমি কামারহাটে বেড়াতে এসেছ নাকি?


হ্যাঁ দাদু। 


তা বেশ ভালো করেছ। হাসলো বুড়ো। হাসতে হাসতে পা ছড়িয়ে বসে পড়লো নদীর পাড়ে। তারপর হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মুখে তখনো হাসির রেশ লেগে আছে। বুড়ো হাসতে হাসতে কাঁদছে।


কী হলো দাদু?


কতোদিন বাড়ি যাই না। মায়ের হাতের পিঠে খাই না। বিলে মাছ ধরি না। 


যাবে তুমি বাড়ি?


বুড়োর চোখ নেচে উঠলো। 

তুমি নিয়ে যাবে আমাকে?


আমি মৃদু হাসলাম, বললাম, তুমি ঠিকানা বলো। আমি নিয়ে যাবো।


বুড়ো উৎসাহিত হয়ে বললো, বললাম তো, এই নদী তারপর আরো একটু গিয়ে, একটা বিল, তারপর বড় একটা নদী। তারপর কামারহাট। যসাই ঠাকুরের গ্রাম বললেই সবাই চিনবে। 


বুড়োটার উপর করুণা হলো। আমাকে চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলেও আমি গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক আমার গ্রামে ফিরে যেতে পারবো, এমনকি পালবাজারেও চলে যেতে পারবো। এ সেটা পারবে না। নিজের জন্মস্থানে যাওয়ার পথই ভুলে গেছে লোকটা। 


এমন সময়ে এক জোয়ান কণ্ঠ ভেসে এলো পিছন থেকে, দাদু। তুমি এখানে কী করছো? বাড়ি চলো। 


আমরা দুজনে পিছনে ফিরলাম। আমারই বয়সী একটা ছেলে দাঁড়ানো। ছেলেটির চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। ছেলেটি এগিয়ে এলো বুড়োর কাছে, হাত ধরে দাঁড় করালো। 

বুড়ো তখন আমাকে দেখিয়ে বললো, এ আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে বলেছে। মায়ের কাছে।

ছেলেটি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, একচুয়ালি দাদুর স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে, কিছু মনে করবেন না। কেবল ছোটবেলার কথাই মনে আছে ওঁর। যে গ্রামে ওর জন্ম, সেই গ্রামের কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে।


গ্রামটা কোথায় আপনারা জানেন না?


উঁহু। ঢাকার আশেপাশে কোথাও হবে জানি। একজ্যাক্ট জানি না। স্মৃতি নষ্ট হওয়ার আগে তো কোনোদিন দাদু ওপার বাংলার কথা আমাদের বলেনি। তাই ঠিকঠাক জানি না। এখন যা বলে তার অর্ধেক তো বুঝতেই পারি না।

আচ্ছা চলি। সন্ধে হয়ে আসছে। 


যেতে যেতে বুড়ো আমাকে দেখিয়ে আবার বললো, মনে আছে তো। ওই সামনে বাংলাদেশ, একটা বড় নদী, তারপর একটা বিল। তারপর কামারহাট। যসাই ঠাকুর। 


আমি ঘাড় নাড়লাম। হ্যাঁ মনে আছে। আমরা যাবো একদিন। 


ওরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমিও উঠলাম। বড় বেশি নির্জন লাগছে চারপাশ। বুড়ো চলে যাওয়ার পর থেকেই এক অপার্থিব শূন্যতা আমাকে গ্রাস করছে। কামারহাট গ্রাম। না জানি বাংলাদেশের কোথায় লুকিয়ে আছে সেই বটতলা, যসাই ঠাকুর। স্মৃতিভ্রষ্ট বুড়োর যুবতী মা, মায়ের হাতের পিঠে। 


বৌদির বোনের সঙ্গে অমিতের বেশ ভাব হয়ে গেছে দুদিনেই। আরো দুদিন বালুরঘাট কাটিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। এই চারদিনে আর একবারও বুড়োটার সঙ্গে দেখা হয়নি। ভালোই হয়েছে দেখা না হয়ে, হয়তো আবার অমন মৃত শাদা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বুড়োটা বলবে, কবে নিয়ে যাবে। 

আমাকে তখন মিথ্যে ছলনার আশ্রয় নিতে হবে। তারচেয়ে না দেখা হয়েই ভালো হয়েছে।


স্টেশনে পৌঁছালাম আমরা। ট্রেনের মিনিট কুড়ি দেরি। পাশের একটা গাছের নিচে সঞ্জয় সীমা বৌদি অমিত আর সেই মেয়েটি গল্প করছে। আমি এদিকে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট টানছি। হঠাৎ নজর পড়লো স্টেশন থেকে সেই ছেলেটি নেমে আসছে, বুড়োর নাতি, সঙ্গে আরো দুতিনজন লোক। 


আমি দ্রুত পায়ে ছেলেটির দিকে হেঁটে গেলাম। একবার তাকিয়েই ছেলেটি আমাকে চিনতে পারলো, আরে আপনি! ভালোই হয়েছে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে। 


কেনো বলোতো?


ছেলেটি করুণ হেসে বললো, দাদু আর নেই। বাড়ি ফিরে সেই রাতেই  মারা গেছে। শেষ সময়ে বারবার ওঁর মায়ের কথা বলছিল। মায়ের কাছে যাচ্ছে, বাড়ি ফিরছে। 


কেমন স্থাণু হয়ে গেলাম কথাটা শুনে। স্বাভাবিক হয়ে কিছু বলবো তার আগেই শুনতে পেলাম স্টেশনের মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, কোলকাতা যাওয়ার ট্রেন এক নম্বরে আসছে।


 আমাদের বাড়ি ফেরার ট্রেন।

Comments