নদীর নাম আত্রেয়ী

|| নিজে বুঝে নিন || A short story by- Agnibha Maity


আজ সকাল থেকেই মেঘের অবস্থা ভাল নয়।  এখন আবার বিকেল থেকেই মুশলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এ বৃষ্টি যে খুব তাড়াতাড়ি থামার নয় তা আমি আগে থাকতেই বুঝতে পেরেছিলাম, তাই সন্ধ্যেবেলায় ছাতাটা সঙ্গে করে নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম।

আজ তিন বছর ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় স্টেশনমাস্টারের কক্ষের ওপরের ঘরটায় আমাদের আড্ডা বসে। আমারই মত ব্যাচেলর কর্মরত কয়েকজন ওই আড্ডায় সরিখ হত। রাত ৯ টার ১৯০২৩ আপ কালকা মেল যাওয়ার সাথেই আমাদের আড্ডা ভাঙ্গে।
আলতো ভেজা শরীরে ঘরে ঢুকতেই দেখি রেন কোট, ছাতা মোটামুটি হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই নিয়েই চলে এসেছে। আমারই বরং ঢুকতে দেরি হোল। 

আমাদের এই ব্যাচেলার গ্রুপে মোট মিলে আমারা সাতজন। আমরা একসাথে অনেক ছোটখাটো ট্রিপও করি। এইত গত শ্রাবণেই নিধুবাবুর কথায় আমরা দুদিন সময় বের করে ঘাটশিলা ঘুরতে গিয়েছিলাম। সে এক দারুন অভিজ্ঞতা। যে যখনই কোন ভাল জায়গার সন্ধান পায়, আমরা সময় বের করে ছুটিছাটা নিয়ে সেই জায়গার উদ্দেশ্যে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি।

নিধুবাবু হলেন গিয়ে আমাদের মধ্যে Senior Most। আমারা বাকিরা সবই ওই চারের ঘরে। আমরা সবাই মাঝের টেবিলটাকে ঘিরে বসে আছি। রানা TVর পাসের শেল্ফটা থেকে তাস আনার জন্যে উঠতে যাবে এমন সময় প্রচণ্ড জোরে কাছে কোথাও একটা বাজ পড়ে কারেন্টটা চলে গেল। শিবু গিয়ে জানলা গুলো খুলে দিল। অন্ধকার ঘরটা বাজ পড়াতে মাঝে মাঝে আলোয় ভরে যাচ্ছে।  

ফিরে এসে শিবু বলল, “অনেকদিন হোল আমরা কোথাও ঘুরতে যাইনি। তো শনি-রবি দেখে কোথা থেকে ঘুরে এলে হতনা”?
    
“যাওয়াই যায়। খুবই ভাল, কোথাও ঘুরে টুরে এলে” বললেন নিধুবাবু।

“হ্যাঁ, ঠিকই তো! কতদিন আমারা ঘুরতে বেরইনি। মনটাও ভাল থাকবে। কি ভাই অনি, ভাল হবে না”? প্রশ্ন করল তপন।

এই অনি অর্থাৎ  অনিকেত মজুমদার  হলাম আমি। এইখানে আমার পরিচয়টা একটু দিয়ে নিই। বিগত ৩ বছর ধরে আমি এই পানিহাটি তে আছি। সরকারি দফতরে চাকরি। সরকার থেকেই কোয়ার্টার পেয়েছি। বিয়ের ঝামেলা কোনকালেই পছন্দ ছিল না, তাই স্বছন্দে ব্যাচেলার জীবন যাপন করছি। খুশিও আছি।আমি বললাম, “অবশ্যই। কিন্তু কোথায় যাওয়া হবে সেটা কি ঠিক করলে”?

নিধুবাবু বললেন, “ মায়াপুর গেলে কেমন হয়? বেশ একটা আধ্যাত্মিক পরিবেশ। ৯৭-এ একবার গিয়েছিলাম। কি অপূর্ব। মনে হয় সারাদিন ওইখানে বসেই থাকি। চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান। চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থানে যে মন্দিরটি আছে তা ১৮৮০ সালে ভক্তিবিনদা ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন, জবলপুরে।  প্রতিবছর প্রচুর ভক্তবৃন্দের সমারোহ হয় ইস্কনে। আমাদের থেকে তো রাশিয়ানরা ওখানে বেশি”।

আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত ওনার কথা শুনছিলাম। সত্যি মানুষটার সব বিষয়ে অপার জ্ঞ্যান। তার জন্য বিন্দুমাত্র অহং বোধ নেই। আমারা সবাই এবারেও ওনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হল পরের শুক্রবার যে যার কাজ সেরে বিকেলের দিকে আমরা রওনা দেব।
 
যখন ট্রেন ছাড়ল ঘড়িতে ছোট কাঁটাটা ৫এর গণ্ডি পার করেছে। আমাদের নামতে হবে নবদ্বীপ স্টেশনে। ওখান থেকেই জলপথ ও স্থলপথ হয়ে মায়াপুর। আমারা সবাই ডাইরেক্ট স্টেশনে এসেছি তাই সারাদিনের ক্লান্তির পর ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। আড়াই ঘণ্টার যাত্রা পথে দুঘণ্টা ভালই ঘুম দিয়েছিলাম।

সাড়ে সাতটা নাগাদ যখন আমরা নবদ্বীপে নামলাম তখন প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই মুশল ধারে বৃষ্টি শুরু হল। সবার কাছে ছাতা, রেনকোট থাকা সত্ত্বেও ভিজে গেলাম। মুহূর্তের মধ্যে স্টেশনটা এক্কেবারে খালি হয়ে গেল। আমরা সাতজন ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেলাম না। কিছু লোক ঢুকল রেস্ট রুমে, কিছু ঢুকল স্টেশনমাস্টারের ঘরে। বাকি যারা ছিল তাদের কেউ কেউ রিক্সা এমনকি দৌড়ে দৌড়েই চলে গেল। রয়ে গেলাম শুধু আমরা সাতজন। নিধুবাবু অভিজ্ঞ লোক ছিলেন। তিনি বললেন, “শোন তোমরা কয়েকজন একটু এগিয়ে গিয়ে দেখ যদি কোন রিক্সা পাওয়া যায়। আমরা এখানেই অপেক্ষা করব”।

রিক্সার খোঁজে বেরিয়ে গেল গগন আর রানা। আমরা বাকিরা স্টেশনেই একটা শেডের তলায় দাঁড়িয়ে রইলাম। মিনিট কুড়ি পড়ে যখন গগনরা ফিরল তখন সবাই একটু সস্তি বোধ করলাম। কিন্তু যেটা এসেছিল তাকে রিক্সা না বলে ভ্যান বলাটাই শ্রেয়। অতঃপর সময় নষ্ট না করে আমরা এর তার ঘাড়ে চেপে নিজেদের এডজাস্ট করে বসে পড়লাম। ভ্যানচালক রফিকের কাছ থেকে জানতে পারলাম ওপারে যাওয়ার নৌকা বৃষ্টির জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। কোন মাঝীই আর এই সময় জালঙ্গির জলে যেতে চাইছে না।

এই দুর্যোগের রাতে এমন একটা বিশ্রী খবর শুনে সবাই বেশ মুষড়িয়ে পড়লাম। যখন ফেরিঘাটের কাছে পৌঁছলাম তখন ৯টা বাজে। রফিক আর কোন দামেই আমাদের ফেরিঘাট থেকে মেন শহরের দিকে নিয়ে যেতে রাজি হল না। অগত্যা ঠিক হোল আসে পাশের কোন গ্রামের লোকের ঘরে গিয়ে ঠাঁই নেব রাতটুকু। তারপর কাল সকালে মায়াপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেব। এরই মাঝে এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজার ফলে তপনের প্রচণ্ড জ্বর এল।আমি, রানা ও গগন ওই মুশল ধার বৃষ্টিতে বেরিয়ে পড়লাম আজকের রাতটা মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজার জন্য। বাকিরা একটা গাছের তলায় ছাতা নিয়ে তপনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল।   


ফেরিঘাট থেকে কিছুদুর এগিয়ে আসতেই বাড়িটা আমাদের চোখে পড়ল। এত আশ্চর্য ব্যাপার! আসার সময় তো কই বাড়িটা কারোরই চোখে পড়েনি। বাড়িটা দেখতে পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিলাম অবাকও ঠিক ততটাই হয়েছিলাম। একটা দোতালা বাড়ি। মাঠের মাঝখানে ওই একটিই। আসেপাশে আর কোন বাড়িই চোখে পড়লো না। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে যখন বাজ পড়ছে, সেই আলোতে দেখলে মনে হচ্ছে কোন এক অভিশাপের ছায়া-মূর্তির প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ওই বাড়িখানা। গা ছম ছম করে ওঠে। অনেকদিন ব্যবহার হয়নি বাড়িটা। শ্যাওলায় ভরে যাওয়া দেওয়ালগুলো তারই প্রমান দিচ্ছে। আমরা তাড়াতাড়ি করে বাড়িটার কাছে গেলাম। লোহার গেট ঠেলে বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

রানাকে বললাম, “ এই দেখ তো কোন জানলা খোলা টোলা আছে নাকি!”

রানা চলে গেল। আমি আর গগন দরজায় অনেকবার টোকা মারলাম। “কেউ আছেন বাড়িতে” বলে ভদ্রতার খাতিরে দুএকবার হাঁক ও দিলাম। তারপর যখন বুঝলাম যে বাড়িতে কেউই নেই, একটা রাত এখানে আরামে কাটানো যাবে, তখন রানাকে পাঠিয়ে দিলাম বাকিদের ডেকে আনার জন্য।

বাড়িটায় নিচের তলায় দুটো রুম। একটা ভেতর ঘর, আরেকটা দরজা খুলেই সামনের ঘর। আমরা ধরাধরি করে তপনকে ভেতরের ঘরটায় শুইয়ে দিলাম। নিধুবাবু একটা ক্যলপল  খাইয়ে দিলেন। নিধুবাবু বলেন, “ Basic Medicines সবসময়ই নিজের সাথে রাখি। কি জানি কখন কোনটা দরকার পড়ে যায়”। ওনার অভিজ্ঞতা আজ আমাদের কাজেও লাগল। আমরা ঠিক করলাম তাস খেলে গল্প করেই বাকিরাতটা কাটিয়ে দেব। এখন বাজে ১ টা। আর তো কয়েকটা ঘণ্টা, তারপরেই সকাল হয়ে যাবে, একেবারে হোটেলে গিয়েই ঘুমনো যাবে।

তাস তো চলছেই, সাথে চলছে গপ্প। ভূতের গপ্প। রানা মোটামুটি কেত টেত দেখিয়ে বলল ও নাকি একেবারেই ভূতে বিশ্বাস করে না। ও নাকি ভয় কি জিনিস সেটাই জানে না। আমরা বেশি না ঘাটিয়ে কথাগুলো থুড়ি ওর গপ্পগুলো নীরবে হজম করে গেলাম। কিন্তু নিধুবাবু অতিস্ট হয়ে পড়লেন। বললেন, “শোন হে ছোকরা ! তোমার এখন ইয়ং বয়স। রক্ত গরম। তাই কোন কিছুই তুমি বিশ্বাস কর না। কিন্তু যেদিন সত্যিকারে একটা ভূতুড়ে পরিস্থিতিতে পড়বে তখন তোমার শুধু রক্ত কেন সব কিছুই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে”।

নিধুবাবু আমাদের থেকে বয়সে অনেক বড়। ওনার কাছ থেকে এরম একটা উত্তর পেয়ে আমরা প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম বইকি! তারপর আমরা সবাই হাসিতে ফেটে পড়লাম। রানা কিছুক্ষণ কোন পাল্টা জবাব দিতে না পেরে আমতা আমতা করতে থাকল। আর ঠিক এই সময় ঘটনাটা ঘটল।

শিবু হটাৎ আমাদেরকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, “তপন কি ঘুম থেকে উঠে গেছে”?

“অসম্ভব! ওকে হাই ডোজের ওষুধ দিয়েছি। ওর তো এখন অঘোরে ঘুমনোর কথা। কেন বলত”? বললেন নিধুবাবু।

“ তাহলে ওপরের ঘরে কে আছে”?

সত্যি তো! আমাদের ঠিক ওপরের ঘরটায় কেউ যেন এক কোন থেকে আরেক কোনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। স্নেহাংসু তৎক্ষণাৎ পাশের ঘরে চলে গেল তপন আছে কিনা দেখতে।         
    
আমি বললাম, “ আচ্ছা নিধুবাবু ! এমনও তো হতে পারে যে হয়ত তপনের ঘুম আসছে না বা ওষুধটা ঠিক মত কাজে দিচ্ছে না”।

“ তা হতে পারে। কিন্তু কি বলত প্যারাসিটামল হল জ্বরের মোক্ষম ওষুধ। কাজে দেবেই সে রোগীর অবস্থা যেমনই………” নিধুবাবুর কথাটা শেষ হোল না। ওঘর থেকে দৌড়ে দৌড়ে এসে স্নেহাংসু বলল তপন আগের মতই তার জায়গায় ঘুমিয়ে আছে। তাহলে ওপরের ঘরে কে আছে?

“আরে ! বিড়াল বা ওই জাতীয় কিছু হবে হয়ত,” রানা বলল।

নিধুবাবু বললেন, “ বিড়াল বা ওই জাতীয় কোন কিছুই দুপায়ে হাঁটে না। আর হাঁটলেও তাদের পা ফেলে চলার কোন আওয়াজ হয় না,” একটু ব্যঙ্গ ভরে এবং রেগে গিয়েই।

ওপরে হাঁটা এখন থামেনি। আমরা এবার একটু একটু ভয় পেতে শুরু করেছি। কিন্তু রানার মতে আমরা মিছি মিছি ভয় পাচ্ছি। নিশ্চয়ই কোন জন্তু এই দুর্যোগের রাতে বৃষ্টির থেকে বাঁচার জন্য বাড়িটায় ঢুকে পড়েছে। ওর যুক্তিটাও নেহাত ফেলনা নয়। আমরা সবাই একটু স্ট্যেবল হলাম। কারোর কাছেই টর্চ ছিল না। তাই একটা দেশলাই জ্বালিয়ে কাছেই পড়ে থাকা একটা কাঠের অংশতে একটা ছেঁড়া কাপড় জড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দিলাম। একটা মশাল মত তৈরি হয়ে গেল। মশালটা নিয়ে আমরা কাঠের ভাঙা সিঁড়ি চড়ে ওপরে উঠলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সামনে একটা লম্বা করিডোর তারই দুপাশে দুটি ঘর সামনা সামনি। যে ঘরটা থেকে আওয়াজটা পেয়েছিলাম সেটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম।  দেখলাম দরজাটা হালকা খোলা। ঘরের ভেতর থেকে একটা ক্ষীণ আলো আসছে।মনে হয় জানলা খোলা আছে। গগন খুবই ধীরে ধীরে দরজার হাতলটা ধরে জোরে ঠেলে খুলে দিল। এসে দেখলাম কই কেউ তো নেই।আমাদের সবার মধ্যে আবার ভয়টা ফিরে এল, এবার রানাকেও দেখে একটু ভীত মনে হোল। এমন সময় হটাৎ বাড়িটার কাছেই কোথাও খুব জোরে একটা বাজ পড়লো। আমরা যে যেখানে ছিলাম “আ…...আ…...অরে বাপ রে…” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে নিচে নেমে চলে এলাম।

আমাদের কারোর মাথায় কিচ্ছু ঢুকছিল না।
ওপরের ঘরে কে হাঁটছিল ? সে কোথায় গেল ? সে কি মানুষ না কোন জানোয়ার ?

এসব ভেবে ভেবেই সবাই একেবারে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে পড়লাম। রানা একেবারে চুপ মেরে গেছে। গগন, শিবু স্নেহাংসু,রতনও দেখলাম বিড়বিড় করে যাচ্ছে। আমিও যে ভূত তাড়ানোর কোন মন্ত্র জপ করছিলাম না এটা বললে ভুল হবে। একমাত্র নিধুবাবুই দেখলাম এখনও নিজের নার্ভের ওপর দারুন কন্ট্রোল রেখেছেন। চোখে মুখে ভয়ের লেশ মাত্র নেই।

কিছুক্ষণ পর আবার সেই ওপরের ঘরে কারোর হাঁটা শুরু হয়েছে। আবার সেই ধীরে ধীরে ঘরের এক কোন থেকে আরেক কোনে হাঁটছে। রানা দেখি এবারে কেঁদে ফেলেছে।

নিধুবাবু বললেন, “ আহা! রানা কি করছ টা কি ! এরম বাচ্চাদের মত কাঁদছ কেন? আমরা তো আছি নাকি। শান্ত হও”।

হটাৎ “আআআ…………” সে এক ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে উঠেছে তপন। আমাদের গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। আমরা তাড়াতাড়ি করে ভেতরের ঘরটায় গেলাম।

“কি হয়েছে তপন? এরমভাবে চিল্লিয়ে উঠলে কেন?” জিজ্ঞেস করল শিবু।

তপন বলল, “ আমি শুয়ে ছিলাম। ঘুমটা হালকাই ছিল। হটাৎ অনুভব করলাম কেউ আমার মাথার কাছে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। প্রথমটা অদ্ভুত কিছু মনে হয়নি। কিছুক্ষণ পর মনে হল একজন ছেলের পক্ষে এত সরু ও নরম হাত হওয়া অসম্ভব। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পিছনে ঘুরে দেখি কেউ নেই। কিন্তু ওই যে” দরজার কোণটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে, “ ওইখানে একটা বিড়াল বসে ছিল”।

“বিড়াল?? কই? কিছুই তো দেখছি না। ওই ঘরেও তো নেই” রতন বলল।

“ছিল...ছিল… একটা বিড়াল ছিল। আমি নিজের চোখে দেখেছি” একটু জোর গলাতেই বলল তপন।

“আচ্ছা ঠিক আছে! ঠিক আছে! তপন চল ওঠ। তুমি এবার ওই ঘরে আমাদের সাথেই থাকবে চল” বললেন নিধুবাবু।

আমরা সবাই আবার সামনের ঘরটায় এসে ভাল করে দুইদিকের দরজা লাগিয়ে বসলাম। এসে দেখলাম ওপরে হাঁটার আওয়াজটা আর নেই। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে অঝরে, তাও যেন মনে হচ্ছে বাড়িটার মধ্যে এক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। দরজার কোন থেকে আসছে বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজ। ইতিমধ্যে আমাদের মশালটাও গেল নিভে। যদিও একটু সাহস পাচ্ছিলাম ওই আলোটার জন্য এখন আর সেটাও নেই। আর ঠিক তখনই কে একজন খুব ভিতর ঘরে যাওয়ার যে দরজা সেটা খুব জোরে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে। এরম দরজা ধাক্কানোর শক্তি কেবল মানুষেরই আছে। একটা সময় মনে হতে লাগল এই বুঝি দরজাটা ভেঙ্গে গেল। 

নিধুবাবু চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেই চলছেন, “কে ওখানে? কে? কি চাও? কে সামনে এস, আমরা কারোর ক্ষতি করতে আসিনি। কে ওখানে? বন্ধ কর এসব”। কিন্তু জবাবে কোন উত্তর আসেনি। বরং আরও জোরে জোরে ধাক্কা দেওয়া শুরু হোল।

এমন সময় আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে রানা তার ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করে দরজার দিকে ছুঁড়ে দিল। অব্যর্থ নিশানা। একদম দরজার মাঝখানে গিয়ে গেঁথে গেল ছুরিটা আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা ধাক্কা দেওয়াটাও বন্ধ হয়ে গেল। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল যে আমারা সবাই অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকিয়েই রইলাম। রানা যখন দরজা থেকে ছুরিটা বের করে আনল তখন যা দেখলাম তাতে আমাদের চক্ষু চড়গগাছ হয়ে গেল। দ্বিতীয়বার আরেকটা মশাল জ্বালিয়ে দেখলাম ছুরিতে রক্ত লেগে আছে। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম রক্তের ছিটে ফোটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। সকলের গলা শুকিয়ে আসছিল।

এরম একটা বাড়িতে আমরা সাতজন ছারাও অতিরিক্ত একজন উপস্থিত আছে! আর আমরা সেটা বুঝতেই পারিনি এতক্ষণ! তাকে দেখা যায় না শুধু অনুভব করা যায় ? তাকে শোনা যায় না ? কিন্তু তার রক্তের দাগ তার উপস্থিতির প্রমান দেয় ! এও কি সম্ভব ?

“এই হানা বাড়ি থেকে এক্ষুনি পালিয়ে চল। আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়,” ভীত ও কম্পিত গলায় বলল শিবু।
“হ্যাঁ… হ্যাঁ… এখুনি চল… আর এক মুহূর্ত এখানে থাকব না,” রতন বলল।

“তা হয় না। এই দুর্যোগে কোথায় যাবে? বৃষ্টিতে ভিজে মরে যাবে। বৃষ্টিতে ভিজে না মরলে বাজ পড়ে মরে যাবে,” নিধুবাবু বললেন।

“কিন্তু নিধুবাবু এখানেও তো আর থাকা যায় না। অলৌকিক সব ব্যাপার ঘটছে এখানে। বাইরে গিয়ে কোন না কোন গ্রামবাসির ঘরে থেকে যাব,” রতন বলল।
“এখানে আসার সময় দূর দূরান্তেও কোথাও কোন ঘর দেখেছিলে ? ঘর দূরে থাক! কোন মানুষকে দেখেছিলে? আর এখানে অলৌকিক কি ঘটছে? হতেও তো পারে কোন চোর বা ডাকাত এখানে পুলিশের ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে আছে। আমরা আসাতে ওর ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ও আমাদের ভয় দেখাচ্ছে,”।

আমি বললাম, “দেখ! আমার মনে হয় নিধুবাবু ঠিক কথাই বলছেন। এইসময় বাইরে বেরোনো টা নিরাপদ নয়”।

আমরা সবাই এবার মশালটায় আরও একটা কাপড় জড়িয়ে আগুনটা জোরালো করলাম। এখন ঘরে একটা নয় দুটো মশাল জ্বলছে। একটা শিবু ধরে বসেছে আরেকটা আছে রানার কাছে। আগের মতই আমরা গোল হয়ে ঘরের মাঝখানে এসে বসলাম। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলিনি। মনটা ব্যস্ত রাখার জন্য আবার তাস খেলতে শুরু করলাম।

রিষ্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে তিনটে বাজে। আর ১ ঘণ্টা পরেই সূর্য উঠবে, অন্ধকার দূর হয়ে আলো ফুটবে। তখন আর কোন ভয়ই থাকবে না।
এমন সময় আমার নজর পড়ল ঘরের ঈশান কোনের দিকে। আমার সাথে সাথে সবাই জিনিসটাকে দেখল। একটা বেড়াল। একটা ধপ ধপে সাদা বেড়াল। আমাদের দিকেই তাকিয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে যেন গায়ে কেউ সাদা রঙ মাখিয়ে দিয়েছে। তারপরেই বিড়ালের বুকের কাছটায় মশালের আলোটা পড়তেই আমাদের সকলের রক্ত হিম হয়ে গেল। ওর বুকের কাছে ক্ষত, এখন রক্ত জমে শুকিয়ে গেছে।

কারোর বুঝতে বাকি রইল না ওই ক্ষতটা কোন ছুরির আঘাতেই হয়েছে। আমরা কিছু ভাবতে পারছিলাম না। মৌন হয়ে গেছিলাম। একটা বেড়ালের কি এত জোর ? মানুষের মত করে কি বেড়াল ধাক্কা দিতে পারে ? বিড়াল মানুষের সমান উচ্চতায় উঠে কিভাবে দরজা ধাক্কা দেয় ? এও কি সম্ভব এই হানাবাড়িতে ?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের জানাছিলনা। এরম ভৌতিক পরিস্থিতিতে এর আগে আমরা কোনোদিন পড়িনি। বিড়ালটা নড়েও না চড়েও না। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মশালের আলোতে ওই বিভীষিকাময় জ্বলন্ত চোখ আমাদের একটু একটু করে গ্রাস করছিল।

এমন সময় হটাৎ রানা “ ওটা কে………” বলে বীভৎসভাবে আঁতকে উঠল। আমরা ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও আঙ্গুল দিয়ে দেওয়ালের দিকে নির্দেশ করছে। দেওয়ালে চোখ পড়তেই শিরদাঁড়া দিয়ে রক্তের ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসছিল। এতক্ষণ শুধু বিরালটার দিকেই তাকিয়েছিলাম বলে দেওয়ালটা লক্ষ্য করিনি। বিড়ালের ছায়াটা পরেছিল দেওয়ালে। আর সেই ছায়ায় স্পষ্ট ফুটে উঠছিল এক নারীমূর্তি।

ওইদিন নিধুবাবুর একটা ম্যসিভ হার্ট-অ্যাটাক হয়। নিধুবাবু মাটিতে ধপ করে পড়ে যান। তারপর ওই ছায়ামূর্তি আর বেড়াল কনটাকেই দেখতে পাইনি। আমরা নিধুবাবুকে ধরাধরি করে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাই। তখন সকাল হয়েই এসছিল। রতন, শিবু একটা ভ্যান ডেকে এনেছিল। আমরা মূল শহরের একটা হাসপাতালে ওনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছিলেন উনি হার্ট-অ্যাটাকের পর ২-৩ মিনিট বেঁচে ছিলেন। আমরা ওনাকে নিয়ে যেতে দেরি করে ফেলেছিলাম।ওনাকে দাহ আমরাই করেছিলাম। 

আমাদের আড্ডা আগের মতই সন্ধ্যে বেলায় বসত কিন্তু সেটা আর রাত ৯ টার কালকা মেলের জন্য অপেক্ষা করত না। আমাদের ঘুরতে যাওয়া নিয়ে আলচনা অনেক হত। কিন্তু নিধুবাবুর মত করে একটা জায়গা সম্পর্কে মজাদার সব তথ্য কেউ দিতে পারতাম না। ওই ঘটনার পর থেকে আমরা আর কোথাও ঘুরতে যাই না।

শুধু একটাই জিনিস আমাদের বারবার ভাবিয়ে তুলত। পরদিন সকালে আমরা সবাই যখন হাসপাতালে গিয়েছিলাম, তখন এক নার্স রানার জামায় রক্তের দাগ দেখে ওকে ফার্স্ট এইড করার জন্য জামা খুলতে বলেছিল। আমরা অবাক হয়েছিলাম, রানার বুকেও ঠিক সেই বিড়ালটার মতই ক্ষত চিহ্ন, যেন কেউ ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। 

রানা রোজই আড্ডায় আসত। আমরা রোজ ওকে দেখতাম। আজ একবছর হয়ে গেল ওই ঘটনার কিন্তু সেই ক্ষত চিহ্ন এখন রানার বুকে রয়ে গেছে।  

Comments